Close

আমার ৫০ বছর রাজনীতির সার সংক্ষেপ

এম এ কাশেমঃ আমি আমার পরিবারের সাত ভাই বোনের মধ্যে ছোট। বড় ভাই মরহুম এম, ছিদ্দিক বিয়ে করেন আমার জন্মের পূর্বে, কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। মেঝো ভাই আবুল হাসেম বি, এ ১৯৭৪ সনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭৫ সনের ১৪ আগষ্ট বাড়ি ভর্তি মেহমান, কারন মেঝো ভাবী ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সাধভক্ষণের আয়োজন।(সাধ বা সাধভক্ষণ হলো বাঙালিদের একটি গর্ভাবস্থাকালীন ঐতিহ্যবাহী আচার অনুষ্ঠান। গর্ভবতী নারীর গর্ভধারণের সাত মাস পূর্ণ হলে অষ্টম বা নবম মাসে মা ও সন্তানের সুস্বাস্থ্য কামনায় প্রসূতিকে ভাল কিছু খাওয়ানোর প্রথাকেই বলা হয় সাধভক্ষণ)।


দিনটি ছিল শুক্রবার ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫। বিশাল আয়োজন। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী কি ছিলনা ঐ আয়োজনে। অনেক অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা।

আমি ভোরের দিকে একটু রেষ্টে যাই, কিছুক্ষন পরেই সম্ভবত সকাল সাতটা বা সাড়ে সাতটার দিকে এক ভাতিজি জামাই এসে বলে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে।
ঘটনার সত্যতার জন্য রেডিও অন করি, ইতিমধ্যেই সারা বাড়িতে পিন পতন নিস্তব্ধতা, আমার মায়ের চোখে অশ্রু।
তারপর থেকেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার ব্রত নিয়েই এ রাজনীতির মাঠে বিচরণ।

কয়দিন পরই ছিলো আমার এইচএসসি পরীক্ষা। ইতিমধ্যেই খন্দকার মোশতাক নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেন। ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সাহেবকে দল গোছানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো অথচ এ অধ্যাপক সাহেবকে বঙ্গবন্ধু কিছুদিন আগেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
দূর্ভাগ্যবশতঃ অধ্যাপক সাহেবের বাড়ি ছিলো নোয়াখালী আর নোয়াখালীতে দল গোছানোর জন্য তিনি দায়িত্ব দেন আমার কলেজ চৌমুহনী এস, এ, কলেজের ডেমোনেস্টেটর আবদুর রব সাহেবকে। তিনি চৌমুহনীর কোন ছেলে জোগাড় করতে না পেরে চন্দ্রগঞ্জের আজাদ নামের এক ছেলের মাধ্যমে চৌমুহনীর যারা ছাত্রলীগ বা জাসদ ছাত্রলীগে জড়িত, তাদেরকে মিস গাইড করে তাদের দলে ভিড়ানোর কাজ করছিলো। আমি এ সংবাদ পেয়ে আমাদের দলের কর্মী ওয়াহাব, চঞ্চুকে দিয়ে ডেকে নিয়ে বেধড়ক মারধর করি এবং তাকে চৌমুহনী ছাড়া করি। কিন্তু এর খেসারত দিতে হয় আমার এইচএসসি পরীক্ষায়। আবদুর রব সাহেব আমাকে প্রাণিবিদ্যা ব্যবহারিক পরীক্ষায় বহিষ্কার করানোর চেষ্টা করেন, যদিও তিনি সফল হতে পারেন নাই, কিন্তু অবশেষে আমার কিছু নাম্বার থেকে আমি বঞ্চিত হয়ে যাই।

ইতিমধ্যে অনেক রক্তপাত, অনেক ইতিহাস, জিয়াউর রহমান সাহেব ক্ষমতায়, অধ্যাপক আবুল ফজল সাহেবকে তিনি নিয়োগ দেন শিক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে।
তিনি সেশান জট নিরসনে ১৯৭৬ সনে আমরা যারা এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম তাদেরকে পরবর্তী শিক্ষাক্রমে সুযোগ না দিয়ে বসিয়ে রাখেন, ১৯৭৭ সনে যারা এইচএসসি উত্তীর্ণ হন, তাদের সহ পরবর্তী শিক্ষাক্রমে আমরা প্রতিযোগিতায় নামি। পরিবারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ঐসময় আমি আর কোথায়ও সুযোগ পাই নাই। পারিবারিক সিদ্ধান্ত, কোনভাবেই ইউনিভার্সিটিতে পড়া যাবে না। যাইহোক পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে পরিবারকে রাজি করিয়ে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।

১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ এর এ সময়টা আমি মূলতঃ নোয়াখালীর আনাচে কানাচে ছাত্রলীগকে পূনর্গঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করি। অবশেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জনপ্রশাসন বিভাগ থেকে বি,এস,এস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এম,এস,এস করি। উত্তীর্ণ হয়েছি সত্য, কিন্তু আশানুরূপ হয়নি। ক্লাসে যদি সবসময় উপস্থিত থেকে লেখাপড়ায় মনোযোগী হতাম তাহলে আরেকটু ভালো রেজাল্ট করতে পারতাম।

১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্টের নির্মমতা আমাকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাচ্ছিল।জাতিগতভাবে আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য একটা জাতিগত অভিশাপ। আর এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতেই আমি শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির ঝান্ডা হাতে রাজনৈতিক কর্মী হয়ে এ পথে হাঁটা শুরু করি। এরমধ্যেই ১৯৮১ সনের ১৭ মে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আসেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।

আমরা আরো বেশি উদ্বেলিত হই। ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর হই। কিন্তু দূর্ভাগ্য তৎকালিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক ভাই, বাকশাল নামে নতুন দল করে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যান। ১৯৮৪ সনে মাষ্টার্স পরীক্ষা দিয়ে আমি চৌমুহনীতে চলে আসি, তখন চৌমুহনীর সকল আওয়ামী লীগার বাকশাল হয়ে গেছেন।

চাকুরির পিছে না ছুটে উনাদেরকে কিভাবে বাকশাল থেকে আওয়ামী লীগে আনা যায় সে জন্য কাজ শুরু করি।
১৯৮৪ সনের শেষের দিকে সবাই আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সনের ১০ জানুয়ারি আমার বড় ভাই এম, ছিদ্দিক মৃত্যুবরণ করেন।

মেজো ভাইয়ের অনুরোধে চাকুরী না খুঁজে পারিবারিক ব্যবসার একাংশের হাল ধরি এবং ১৯৮৬ সনে নিতান্ত ব্যক্তিগত কারনে, জীবন বাঁচানোর তাগিদে দেশত্যাগ করি। ১৯৮৭ সনের ১২ নভেম্বর ফ্রান্সে আসি এবং ১৩ ডিসেম্বর ফ্রান্স আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করি। সেই থেকে ফ্রান্সের আওয়ামী রাজনীতিতে পথচলা।

১৯৭৫ সনের ১৫ আগষ্ট থেকে যে মনো বাসনা নিয়ে এ পথে হাঁটা শুরু করেছিলাম সেখানে একটা বড় সান্ত্বনা পেয়েছিলাম জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ৩৪ বৎসর ৭ মাস ১২ দিনের মাথায় তাদেরকে ফাঁসির রায় কার্যকরণের মধ্য দিয়ে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বৎসর পর হলেও ১৯৯৬ সনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছিলো। আমরা এসবের জন্য আনন্দিত। মনে করেছিলাম, আমরা যে আমাদেরকে বিসর্জিত করেছিলাম তা বৃথা যায়নি।

২০০৯ থেকে বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।
উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে অনেক ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছি।

বিদেশে যে, যে কারণে আসুক সবাইকে কাজ করতে হবে এটাই বাস্তব। নতুবা আপনার থাকার খরচ, খানার খরচ, হাত খরচ কোনটাই চলবে না। আমি যখন ফ্রান্সে আসি তখন আমার কাছে ১৫০০ ডলার ছিল। কাজ শুরু করেছিলাম কিন্তু ফ্রান্স আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটিতে আমি যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ১৯৮৮ সনের ১০ জানুয়ারির পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আমি সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হই। একাধারে তিন বছরের মতো একরকম বিনা কামে থাকতে বাধ্য হই। ওর্য়াক-পারমিট নাইতো কাজ নাই, কি করব হাওলাতের উপর চলতে হচ্ছে।

৫৫ হাজার ফ্রান্ক লোন হওয়ার পর হুঁশ হয়! তবে আপনি যদি সৎভাবে, সৎনিয়তে থাকলে যত বিপদ আসুক আল্লাহ আপনাকে উদ্ধার করবে। আমার ফ্রান্সের বয়স এবং ফ্রান্স আওয়ামী লীগের বয়স প্রায় সমানে সমান। দেশটা যদি ভালো থাকে, তাতেই আমাদের সন্তুষ্টি।

কিন্তু গত ৫ আগষ্ট থেকে যে বাংলাদেশ আমরা দেখছি, তাতে চোখ ভিজে যায়, ৩০ লক্ষ শহীদান কি এজন্যই জীবন দিয়েছিলো?? ৪ লক্ষ মা-বোন কি এজন্যই সভ্রম হারিয়েছিলো???

দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর দল একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকার কারনে অন্যায় বা অবিচার বা দুর্নীতি হয় নাই, আমি তা বলব না। কিন্তু একটা মিথ্যা গুজব নির্ভর হয়ে, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে এবং বিদেশি প্রভূদের নীলনকশা বাস্তবায়নে যা হয়েছে তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায়না।

আমার রাজনীতির আজ ৫০ বৎসর। শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির ঝান্ডা হাতে নিয়ে আমি শুরু করেছিলাম। দল ক্ষমতায় থাকুক না থাকুক, আমরা ছিলাম, আছি থাকব ইনশাআল্লাহ।

একটা দেশে ভিন্নমত থাকবে, এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
কিন্তু গত ৫ আগষ্ট ২০২৪ থেকে যা হয়েছে বা হচ্ছে তার সমষ্টি করে জননেত্রী শেখ হাসিনার ১৬ বৎসরের শাসন আমলের সাথে মিলানতো দেখি? ভালো কথা শেখ হাসিনা খারাপ, গত ৫ আগষ্ট থেকে সারা বাংলাদেশে যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে অপমানিত করা হয়েছে বা এখনো হচ্ছে এজন্য কি আমরা বা আমার মতো অনেকেই জীবনের ৫০ টা বৎসর ব্যয় করেছিলাম?

১৯৭৫ সনের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো, কিন্তু এবার ৫ আগষ্ট এমনভাবে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিলো যে কোনভাবেই যেন বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা না থাকে।

১৯৭৫ সনের ১৫ আগষ্ট এর চাইতে অনেক বেশি শক্তি নিয়ে তারা হানা দিয়েছে, তারপরেও আমি বলব ১৯৭৫ সনে যারা আমরা দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধের প্রত্যক্ষ যোদ্ধা ছিলাম, এবার ষড়যন্ত্রকারীরা অনেক বেশি শক্তি নিয়ে মাঠে নামলেও এর আগে আমাদের সময় লেগেছিল ২১ বৎসর এবার তা লাগবে না, আল্লাহ চাহেত ২১ মাসেই ইনশাআল্লাহ পটপরিবর্তন হয়ে যাবে।
জয় বাংলা।
জয় বঙ্গবন্ধু।
জয়তু জননেত্রী শেখ হাসিনা।

লেখকঃ বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ। ফ্রান্স আওয়ামী লীগের সভাপতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

0 Comments
scroll to top