শেষ পর্যন্ত ৩০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেনি। তারা কেউ কেউ চার থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন। অনেকে জমিজমা বিক্রি করেছেন। নিঃস্ব হয়ে সবকিছু হারালেন এই সমস্ত নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। তাদের কান্না শুক্রবার বিমানবন্দরকে ভারী করে তুলেছিল।
প্রশ্ন হল যে, এই ৩০ হাজার কর্মী যে মালয়েশিয়া যেতে পারলেন না, সমস্ত জীবনের সঞ্চিত সমস্ত টাকা ধার দেনা করে টাকা গচ্ছিত রেখেও কিছু কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির গাফিলতির কারণে যাদের জীবনে ঘোর অমানিশা নেমে আসলো তারা কী করবেন? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, এর জন্য যারা দায়ী তাদের কি বিচার হবে?
বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, মালয়েশিয়ায় এই বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হল সরকারের ভেতরে থাকা প্রভাবশালী একটি চক্র, যারা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করত। তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, ৪টি রিক্রুটিং এজেন্সি- তারা মালয়েশিয়ায় এই শ্রমবাজারকে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। সরকারি রেটের বাইরে তারা ইচ্ছেমতো শ্রমিক পাঠানোর জন্য ফি ধার্য করত এবং হিসেব করে দেখা গেছে যে দেড় বছরে তারা সাড়ে ৪ লাখ লোককে বিদেশে পাঠিয়েছেন এবং ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন।
যে চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সেনা সেনা কর্মকর্তা, ওয়ান ইলেভেনের সময়ে আলোচিত মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। তার রিক্রুটিং এজেন্সির নাম ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল। আছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। তার রিক্রুটিং এজেন্সির নাম স্নিগ্ধা ওভারসিস। আছেন আওয়ামী লীগের আরেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদ। তার রিক্রুটিং এজেন্সির নাম আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়াও সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রীর অরবিটালস এন্টারপ্রাইস এবং লোটাস কামালের মেয়ের আর একটি রিক্রুটিং এজেন্সি অরবিটালস ইন্টারন্যাশনাল। এরাই মূলত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করত, ইচ্ছামতোভাবে মূল্য হাকাতো এবং এদের কারণেই মালয়েশিয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন।
এখন প্রশ্ন হল যে, যে সমস্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এর সঙ্গে জড়িত, তারা প্রত্যেকে প্রভাবশালী। এরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্য অথবা আওয়ামী লীগের নেতাদের আত্মীয়স্বজন। সরকার কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন?
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আর এখান থেকে অনেকে মনে করেন যে, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। কারণ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই কয়টি রিক্রুটিং এজেন্সির কারণে এই টাকা অনেক বেড়ে গেছে।
২০২৩ সালের মে থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় ৩৫৭ জন মালয়েশিয়া প্রবাসীর সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি জরিপ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ভেরিটে ইনকর্পোরেটেডসহ পাঁচটি সংস্থা। এতে বলা হয়, মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ৯৬ শতাংশ কর্মীকে অন্তত একটি উৎস থেকে ঋণ নিতে হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। শেষ দিনে যারা অপেক্ষমান ছিলেন তারা ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে যে, সরকারের ছত্রছায়া থেকে যারা গরিব মানুষকে এভাবে ঠকালেন এবং মালয়েশিয়া শ্রমবাজারকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিলেন তাদের শাস্তির কি হবে?